এমন কোন নির্যাতন নেই যা করা হয় না চীনের মুসলিম বন্দিশিবিরে

চীনে কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত বন্দিশিবিরে লাখ লাখ মুসলমানকে কৌশলে করা হচ্ছে মগজধোলাই। সঙ্গে চলছে নিপীড়ন-নির্যাতন। গত রোববার ফাঁস হওয়া নতুন নথিতে উইঘুর নির্যাতনের এসব তথ্য বিস্তারিত উঠে এসেছে। বন্দীদের চুলের ছাঁট কেমন হবে, ঘরের দরজা কখন বন্ধ করতে হবে—সবকিছু্ই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ওই সব শিবিরে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) নথিগুলো প্রকাশ করেছে। আন্তসীমান্ত অপরাধ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার জবাবদিহি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ৭০টি দেশের দুই শতাধিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও শতাধিক সংবাদমাধ্যম যুক্ত। চীনের সরকারি ওই নথিগুলো হাতে পেয়েছে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান প্যানোরামা। নথিতে বন্দীদের আটক রাখা, মগজধোলাই ও শাস্তি দেওয়ার তথ্য এসেছে। তবে এগুলো ‘ভুয়া সংবাদ’ হিসেবে নাকচ করে দিয়েছেন যুক্তরাজ্যে চীনের রাষ্ট্রদূত।

চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ জিনজিয়াংয়ে বড় বড় বন্দিশিবিরে প্রায় ১০ লাখ মুসলমানকে আটক রাখা হয়েছে। কোনো বিচার ছাড়াই বছরের পর বছর বন্দী রাখা এসব মানুষের বেশির ভাগই উইঘুর সম্প্রদায়ের সদস্য। এ ঘটনায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ জানালেও চীন সরকারের দাবি, সন্ত্রাসবাদ রুখতে স্বেচ্ছামূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতেই তাঁদের সেখানে রাখা হয়েছে। তাঁদের চলাফেরায় স্বাধীনতা রয়েছে। তবে ফাঁস হওয়া নতুন তথ্যের সঙ্গে বেইজিংয়ের দাবির কোনো মিল নেই।

আইসিআইজে চীন সরকার নথিগুলোকে ‘দ্য চায়না কেবল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এসব নথির মধ্যে ৯ পৃষ্ঠার একটি মেমো রয়েছে। ২০১৭ সালে জিনজিয়াংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির সহকারী সম্পাদক ঝু হাইলুন ও বন্দিশিবির পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শীর্ষ কর্মকর্তারা মেমোটি চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ওই মেমোতে বন্দিশিবিরগুলোকে উচ্চ নিরাপত্তাবিশিষ্ট কারাগার হিসেবে পরিচালনা করা উচিত বলে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখা, শাস্তি প্রদান এবং কেউ যাতে পালাতে না পারেন, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে মেমোতে। এ ছাড়া এতে আচরণ পরিবর্তনে মান্দারিন ভাষা শিক্ষা, আচরণগত রূপান্তরে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি উৎসাহ প্রদান এবং বন্দিশিবিরের ডরমিটরি ও শ্রেণিকক্ষগুলোতে পুরোপুরি সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

বন্দীদের প্রতিটি বিষয় কীভাবে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেই তথ্যও উঠে এসেছে নথিগুলোয়। বন্দিশিবিরগুলোয় শিক্ষার্থীদের ঘুমানোর স্থান, সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর অবস্থান, শ্রেণিকক্ষের আসন ইত্যাদি নির্দিষ্ট করা রয়েছে। এসব পরিবর্তন করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ঘুম থেকে ওঠা, শ্রেণিকক্ষে নামডাকে সাড়া দেওয়া, হাতমুখ ধোয়া, শৌচাগারে যাওয়া, ঘর গোছানো, খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা, ঘরের দরজা বন্ধ করা ইত্যাদি কাজ নিয়ম মেনে করতে হয় বন্দীদের।

শিক্ষাদানের জন্য বিশেষ ধরনের বন্দিশিবিরের তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে অন্য নথিতে। একটি নথিতে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে জিনজিয়াংয়ের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ১৫ হাজার মানুষকে মাত্র এক সপ্তাহের কোর্সের জন্য ওই সব শিবিরে পাঠানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চীনবিষয়ক পরিচালক সোফি রিচার্ডসন বলেন, এই নথি সামগ্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্রই বহন করে।

তবে জিনজিয়াংয়ে কারোর ওপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে না দাবি করে যুক্তরাজ্যে চীনের রাষ্ট্রদূত লিউ জিয়াওমিং বলেন, স্থানীয় ব্যক্তিদের নিরাপত্তার জন্যই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ কারণেই গত তিন বছরে জিনজিয়াংয়ে একটি সন্ত্রাসী হামলাও হয়নি।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেং শুয়াং গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জিনজিয়াংয়ের ঘটনা চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী অঞ্চল হিসেবে জিনজিয়াংকে গড়ে তুলতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *