রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শোক আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে, ‘একটি গান লিখে যিনি অমর হয়েছেন’

স্টাফ রিপোর্টার

`আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’  গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী বৃহস্পতিবার (১৯ মে, ২০২২) ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ার চৌধুরীবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার বাবা হাজী ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা জহুরা খাতুন। ১৯৫০ সালে গাফফার চৌধুরী পরিপূর্ণভাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন।

মাসিক সওগাত, দিলরুবা, মেঘনা, ইত্তেফাক, আজাদ, জেহাদ ও পূর্বদেশসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন বরেণ্য এ সাংবাদিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয়বাংলায় লেখালেখি করেন। এসময় তিনি কলকাতায় দৈনিক আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক জনপদ বের করেন।

১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান তিনি। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে লন্ডনে যান। এরপর তার প্রবাসজীবনের ইতিহাস শুরু হয়।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শোক

বিশিষ্ট সাংবাদিক, গীতিকার, কলামিস্ট ও সাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার (১৯ মে, ২০২২) দুপুরে পৃথক বার্তায় এ শোক জানান।

শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন অগ্রপথিককে হারালো। তার একুশের অমর সেই গান বাঙালি জাতিকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তির আন্দোলনে অসীম সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছিল। তিনি একজন বিশিষ্ট কলামিস্ট। লেখনীর মাধ্যমে তিনি আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে কাজ করে গেছেন। তার মৃত্যু দেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। মরহুম আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁর কালজয়ী গান ও লেখনীর মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন।

রাষ্ট্রপতি মরহুমের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

অন্যদিকে শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‌‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী তার মেধা-কর্ম ও লেখনিতে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন ও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মননকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধিত সাপ্তাহিক জয় বাংলা পত্রিকায় বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। পরবর্তীতে তিনি প্রবাসে থেকেও তার লেখনীর মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার বহু স্মৃতি। অনেক পরামর্শ পেয়েছি। একজন বিজ্ঞ ও পুরোধা ব্যক্তিত্বকে হারালাম যিনি তার লেখা ও গবেষণায় আমাদের বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাসও লিখেছেন । ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘সম্রাটের ছবি’,  ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’,  ‘বাঙালি না বাংলাদেশী’সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৩০। এছাড়া তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছেন।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গাফফার চৌধুরী। ১৯৬৩ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার পান তিনি। এছাড়া বাংলা একাডেমি পদক, একুশে পদক, শেরেবাংলা পদক, বঙ্গবন্ধু পদকসহ আরও অনেক পদকে ভূষিত হয়েছেন।

‘আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো সাহিত্যিক-সাংবাদিক আর কোনোদিন বাংলাদেশে আসবে না। তিনি সাংবাদিকতায় ছিলেন এক নম্বরে, কলাম লেখায় ছিলেন যেমন এক নম্বরে, তেমনি সাহিত্যিক হিসেবেও পঞ্চাশের দশকে ছিলেন প্রথম সারির একজন।’

সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন এ মন্তব্য করেন।

ড. মামুন গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, ‘দীর্ঘ ষাট বছর কলাম লিখে তার মতো আর কেউ সমানতালে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি বাংলাদেশে। সম্ভবত, এটি পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি বিরল ঘটনা। তিনি দেশে থাকলে আরও অনেক অনেক সৃষ্টি আমাদের উপহার দিতে পারতেন। প্রবাসে কষ্টসাধ্য জীবনযাপন করে তার পক্ষে সে উপহার দেওয়া আর সম্ভব হয়নি।’

গাফফার চৌধুরীর বন্ধুসম এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি গণ-আন্দোলনে গাফফার চৌধুরীর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়ে জনমত সৃষ্টিতে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। আমি গতকালই আলাপ করছিলাম, পৃথিবীতে একটি মাত্র গান লিখে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি গাফফার চৌধুরী।

‘যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন যেমন বঙ্গবন্ধুর নাম থাকবে, তেমনি আবদুল গাফফার চৌধুরীর নামও থাকবে। যতদিন আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথা হবে, মুক্তিযুদ্ধের কথা হবে ততদিন গাফফার চৌধুরীরও কথা হবে। এই ভাগ্য নিয়ে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউ জন্মগ্রহণ করেননি।‘

‘আমারা ব্যক্তিগতভাবে কী হারালাম তার বয়ান দিচ্ছি না। আমি তার অত্যন্ত স্নেহের একজন ছিলাম। ফোনে প্রায়ই কথা হতো। আমি শুধু বলবো, পঞ্চাশের দশকের একজন উজ্জ্বল লক্ষত্রকে হারালাম’- যোগ করেন মুনতাসীর মামুন।

গত দু’বছরে বেশ ক’জন গুণীজনকে হারাতে হলো। সৃষ্টিশীলতায় সংকট দেখেছেন কি না? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তা মনে করছি না। সেভাবে দেখলে হবে না। এরকম একেক দশকে অনেকেই জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু এক সময় সবাইকেই চলে যেতে হয়। তবে কোনো স্থানই অপূর্ণ থাকে না। গাফফার চৌধুরী আর ফিরে আসবেন না, কিন্তু তার জায়গা কেউ না কেউ দখল করে নেবে।‘

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *