উড়োজাহাজের টিকিটের মতো ট্রেনের টিকিটের চালুর প্রস্তাব
ঢাকা থেকে রাজশাহীর দূরত্ব প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। এ পথে ট্রেনভাড়া ৩৪০ টাকা। একই রুটে বাসভাড়া ৭২৫ টাকা। আবার বিমানভাড়া তিন হাজার টাকার বেশি। এমন অবস্থায় ট্রেনে যাত্রী চাহিদা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল। তাই এই রুটে চাহিদা বাড়লে ভাড়া বাড়বে, চাহিদা কমলে ভাড়াও কমবে— উড়োজাহাজের টিকিটের মতো এই পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব করেছে তারা।
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের দাবি, নিরাপদ এবং আরামদায়ক ভ্রমণে ট্রেনের প্রচুর যাত্রী চাহিদা রয়েছে, যা ট্রেনের সক্ষমতার চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। ফলে চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ যাত্রী ট্রেনে ভ্রমণের টিকিট পান না। অসংখ্য যাত্রী বিনা টিকিটে ট্রেনে যাতায়াতের চেষ্টা করেন। এতে ট্রেন পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাই কিছু টিকিট সংরক্ষিত থাকবে। যার জরুরি টিকিট দরকার হবে, তিনি বেশি দামে টিকিট কিনবেন। এতে ট্রেনে যাত্রী চাপ কিছুটা কমবে। রেলওয়ের আয় এবং যাত্রী সেবার মানও বাড়বে।
রেলওয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্যই তারা সংসদীয় কমিটিতে ওই প্রস্তাব করেছেন। যদিও সংসদীয় বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। কারণ, ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোসহ অন্য বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই মনিটরিং করছেন। তার নির্দেশনা ছাড়া কোনো প্রস্তাব পাস হবে না।পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের ট্রেনে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। এতে কারও জরুরি প্রয়োজন থাকলে বেশি ভাড়া দিয়ে টিকিট কেনার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে শুধু উড়োজাহাজে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা পান নাগরিকরা। এখন দেশে এই পদ্ধতি চালু হলে যাত্রী সুবিধা কতোটা বাড়বে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন পরিচালনায় প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার। এই ভর্তুকি কমাতে চাইলে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো এবং যাদের জরুরি টিকিট দরকার, তখন চাহিদা বাড়লে ভাড়া বাড়বে, চাহিদা কমলে ভাড়া কমবে এই পদ্ধতি কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। বিষয়টি নিয়ে করণীয় ভাবছে রেলওয়ে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত জুনে সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রেনের ঘাটতি থেকে বের হওয়ার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল। ওই কমিটির প্রতিবেদনে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো, ট্রেন পরিচালনার সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে আয় বাড়ানো, ভূমি ব্যবস্থাপনা, সঠিক রেল ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও জনবল কাঠামোর উন্নয়নের মাধ্যমে আয় বাড়ানোর বেশকিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
পরে গত ৪ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় ওই প্রস্তাবগুলো প্রতিবেদন আকারে জমা দেয় রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল। তবে এই দিন এ বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্মলগ্ন থেকেই ট্রেন পরিচালনায় সরকার ভর্তুকি দিয়ে আসছে। কারণ, এই যানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যাতায়াত করতে পারে। এখন রেলওয়ে উড়োজাহাজের মতো টিকিট ব্যবস্থাপনা এবং ভাড়া বাড়ানোর যে প্রস্তাব করেছে, তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যাত্রীদের যখনই টিকিট দরকার হবে, রেলওয়ে টিকিট দিতে বাধ্য থাকবে। রেলওয়েকে সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি বছর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব করা হয়। এর মাধ্যমে যাত্রীবাহী ট্রেন ও মালবাহী ট্রেন পরিচালনার খরচ বের করা হয়। পরে যাত্রীবাহী ট্রেন ও মালবাহী ট্রেনের প্রতি কিলোমিটার চালানোর খরচ হিসাব করা হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যাত্রীপ্রতি প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ২ টাকা ৪৩ পয়সা। আয় হয়েছে ৬২ পয়সা। মালামাল পরিবহন বাবদ এক কিলোমিটারে প্রতি টনে খরচ হয়েছে ৮ টাকা ৯৪ পয়সা, আয় হয়েছে ৩ টাকা ১৮ পয়সা।
ট্রেন গণমানুষের পরিবহন উল্লেখ করে রেলওয়ের অংশীজন ও বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্মলগ্ন থেকেই ট্রেন পরিচালনায় সরকার ভর্তুকি দিয়ে আসছে। কারণ, এই যানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যাতায়াত করতে পারে। এখন রেলওয়ে উড়োজাহাজের মতো টিকিট ব্যবস্থাপনা এবং ভাড়া বাড়ানোর যে প্রস্তাব করেছে, তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যাত্রীদের যখনই টিকিট দরকার হবে, রেলওয়ে টিকিট দিতে বাধ্য থাকবে। রেলওয়েকে সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
ঢাকার উত্তরার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মোস্তাফিজুর রহমান। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহী। প্রতি মাসে একবার করে তিনি ট্রেনে গ্রামের বাড়ি যান। ট্রেনের টিকিট উড়োজাহাজের মতো করার বিষয়ে মুঠোফোনে তার সঙ্গে আলাপ হয়।
মোস্তাফিজুর বলেন, উড়োজাহাজ আর ট্রেন এক নয়। ট্রেনের টিকিট পদ্ধতি এতো কঠিন করা যাবে না। বরং চাইলেই যাতে যাত্রীরা টিকিট পান, রেলওয়েকে সেই ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন যে ব্যবস্থাপনায় ট্রেনে টিকিট বিক্রি হয়, সেটারই সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারছে না রেলওয়ে। এর মধ্যে যদি কিছু টিকিট সংরক্ষণে রেখে দাম বাড়ানো হয়, তাহলে অব্যবস্থাপনা আরও বাড়বে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজশাহী অঞ্চলের (পশ্চিম) মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদারবলেন, বছরে দুই ঈদ, পূজার মতো বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির সময় ট্রেনে যাত্রীর চাপ বেড়ে যায়। এ সময় ট্রেনের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশিসংখ্যক যাত্রী পরিবহন করতে হয়। উড়োজাহাজের টিকিটের ভাড়া সিস্টেম অর্থাৎ চাহিদা বাড়লে ভাড়া বাড়বে এবং চাহিদা কম থাকলে ভাড়া কম থাকবে, এভাবে চাহিদাভিত্তিক ট্রেনের টিকিটের দাম বাড়াতে প্রস্তাব দিয়েছি। আশা করি সেই প্রস্তাব সংসদীয় কমিটি পর্যালোচনা করবে।
তিনি বলেন, রেলওয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্যই তারা সংসদীয় কমিটিতে ওই প্রস্তাব করেছেন। যদিও সংসদীয় বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। কারণ, ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোসহ অন্য বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই মনিটরিং করছেন। তার নির্দেশনা ছাড়া কোনো প্রস্তাব পাস হবে না।