উদ্বেগজনক সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অবস্থা উদ্বেগজনক বলে মনে করছে অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। তারা বলেছে, অনেক গ্রাহককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ঋণের বিপরীতে জামানত নেই। ব্যাংকটির বড় খেলাপিদের থেকে বার্ষিক আদায়ের হার ১ শতাংশেরও কম।
সোমবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। কমিটির সভাপতি আব্দুস শহীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অংশ নেন কমিটি সদস্য ও চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, এ বি তাজুল ইসলাম, বজলুল হক হারুন, আহসান আদেলুর রহমান, ওয়াসিকা আয়েশা খান এবং খাদিজাতুল আনোয়ার।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি সংসদীয় সাব-কমিটি গঠন করে সোনালী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেড, প্রিমিয়াম লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স লিমিটেডের খেলাপি ঋণের আর্থিক অনিয়ম যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওই সাব-কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ওয়াসিকা আয়েশা খান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আহসান আদেলুর রহমান ও খাজিদাতুল আনোয়ার। কমিটি দীর্ঘ সময় যাচাই শেষ করে গতকাল অনুষ্ঠিত মূল কমিটির বৈঠকে তার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বৈঠকে সাব-কমিটির সুপারিশ মূল কমিটি গ্রহণ করেছে বলেও বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসিকা আয়েশা খান বলেন, সাব-কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এ বিষয়ে কমিটিতে আলোচনা করে পরবর্তী সময়ে সুপারিশ বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হবে। এদিকে, সাব-কমিটির প্রতিবেদনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত করাসহ ১৪ দফা সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সাড়ে ৫ লাখ খেলাপি ঋণ গ্রাহকের সংশ্নেষ অর্থের পরিমাণ ১৭ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ গ্রাহক কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। কিন্তু খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৭৮৬ কোটি। চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের গ্রাহক কিছুটা বেড়ে হয় ৩ লাখ ৯৭ হাজার। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে হয় ১৮ হাজার ৭১২ কোটি। ২০২০ সালের (৬ দশমিক ২২ ভাগ) তুলনায় ২০২১ সালে (৭ দশমিক ৫৯ ভাগ) খেলাপি ঋণ আদায় কিছুটা বেড়েছে।
ডিসেম্বর ২০২০ সালে ১০ কোটি বা তার চেয়ে বেশি ২৩৭ ঋণ খেলাপির সংশ্নেষ অর্থের পরিমাণ ১১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপির সংখ্যা হয় ৩০৮। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেড়ে হয় ১৩ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। ২০২২ সালে খেলাপির সংখ্যা হয় ৩০৯ এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয় ১২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট ঋণের বিপরীতে খেলাপি ১৬ থেকে ১৭ ভাগ। এসব খেলাপি ঋণের মধ্যে বছরে আদায়ের হার এক শতাংশেরও কম; যা মোটেও সন্তোষজনক নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় ঋণের বিপরীতে রক্ষিত সহজামানতের পরিমাণ ঋণস্থিতির ৬০ শতাংশ, যা অপ্রতুল। ঋণ প্রদানে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে ঘাটতি ছিল।
ছোট ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে জামানত ১৫০ শতাংশের মতো। এসব খেলাপি ঋণ আদায়ের হার ৭ দশমিক ৫৯ ভাগ। মোট ঋণখেলাপির মধ্যে ১০ কোটি বা তার চেয়ে মাত্র দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। কিন্তু তাদের কাছে খেলাপি মোট খেলাপির ৬৭ শতাংশ। ব্যাংকটির ছোট খেলাপি ঋণের আদায়ের সম্ভাবনা বড় খেলাপির তুলনায় বেশি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সাব-কমিটি বলেছে, ব্যাংকটির অনেক গ্রাহককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকগুলোর ক্ষেত্রে জামানত নেই। জামানত থাকলেও বিক্রির প্রক্রিয়া জটিল। জামানতের পরিমাণ ও আদায়ের হার আপাতদৃষ্টিতে ভালো দেখালেও ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) ১০ কোটি বা তার চেয়ে বেশি ২৭ জন ঋণখেলাপির ১ হাজার ৪৪ কোটি ৪০ টাকার বিপরীতে এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে কোনো আদায় নেই। এটিকে অত্যন্ত হতাশাজনক ও দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনার পরিচায়ক বলে উল্লেখ করা হয়।
চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ ঋণখেলাপির বিপরীতে ১০ কোটি বা তার চেয়ে বেশি ঋণ ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০২০ সালে এসআইবিএলের মোট বিনিয়োগের (ঋণ) মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের পাঁচ দশমিক ৩২ শতাংশ। ১০ কোটি বা তার চেয়ে বেশি খেলাপিদের কাছে ব্যাংকের দায় ১ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা; যা মোট খেলাপির ৭০ শতাংশ। এ ব্যাংকের বেশিরভাগ ঋণের অনুকূলে জামানত নেই। পার্সোনাল গ্যারান্টরের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছে। বড় ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেশি। ন্যাশনাল ফাইন্যান্স মোট ঋণের (৬৪৩ কোটি) ১৯ শতাংশ খেলাপি। খেলাপি ঋণের ১০ জন গ্রাহকের কাছে।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ১ হাজার ৩৮৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১২০ খেলাপি গ্রহীতার বিপরীতে শ্রেণিকৃত ঋণ ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। যা মোট ঋণের ৯৮ দশমিক ৭৮ ভাগ। এর মধ্যে ১০ কোটি তদূর্ধ্ব খেলাপি ৪৬ জন এবং সংশ্নেষ অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৫৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।