ইন্টারনেট বন্ধে ফ্রিল্যান্সার-উদ্যোক্তাদের ‘বিশাল ক্ষতি’

স্টাফ রিপোর্টার

গত ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সীমিত পরিসরে আন্দোলন শুরু করেন। দিন যতই গড়াতে থাকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরালো হতে থাকে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলা এবং পরে পুলিশ ও ছাত্রলীগের যৌথ হামলার পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ত্রিমুখী সংঘর্ষে রণক্ষেত্র তৈরি হয়। এসব সংঘর্ষে অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশব্যাপী ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮ জুলাই সকাল থেকে ফেসবুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পরে এদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আর্থিকসহ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন ফ্রিল্যান্সার এবং ই-কমার্স ও এফ-কমার্স (ফেসবুকভিত্তিক) উদ্যোক্তারা।

লাখ লাখ ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তারা সম্পূর্ণ ইন্টারনেট নির্ভর হওয়ায় তারা এ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানা গেছে। ইন্টারনেট না থাকায় দেশের ফ্রিল্যান্সাররা বিদেশি গ্রাহকদের দেওয়া মেসেজের উত্তর দিতে পারেননি। আবার অনেকে সম্পূর্ণ করা কাজও গ্রাহককে বুঝিয়ে দিতে পারেননি।

এদিকে, গত ২৩ জুলাই রাতে দেশে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড সেবা এবং রোববার (২৮ জুলাই) বেলা ৩টা থেকে মুঠোফোনে ফোর–জি ইন্টারনেট চালু হলেও দেশে বন্ধ রয়েছে মেটা (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, থ্রেডস), টিকটক ও এক্স-এর ব্যবহার। ইন্টারনেট পরিসেবা ফোর-জির কথা বলা হলেও তা ধীরগতি বলে জানা গেছে।

ফ্রিল্যান্সাররা ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে কাজ শুরু করতে পারলেও ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাতের ব্যবসার প্রচারণা সম্পূর্ণ ফেসবুকনির্ভর হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন এই দুই খাতের কয়েক লাখ উদ্যোক্তা।

রনি আহমেদ নামে চুয়াডাঙ্গার এক ফ্রিল্যান্সার বলেন, বিদেশি প্রজেক্টের একটা কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেয়েছিল। কিন্তু গ্রাহককে বুঝিয়ে দিতে পারিনি। ইন্টারনেট বন্ধের সময়ে অনেক বিদেশি গ্রাহক আমার ফাইবার অ্যাকাউন্টে মেসেজ দিয়েছেন। কিন্তু উত্তর দিতে পারিনি। বেশ কয়েকটি অর্ডার ক্যান্সেল হয়ে গেছে। আমার ফাইবার অ্যাকাউন্টের রেটিং অনেক কমে গেছে। আমার যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা বলে বোঝাতে পারবো না।

নারী উদ্যোক্তা পুরবী সরকার একজন এফ-কমার্স উদ্যোক্তা। তিনি রাজধানী ঢাকার মিরপুর থেকে তার উদ্যোগ পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, বেশ কয়েক মণ আমের অর্ডার ছিল। নেট ও ফেসবুক বন্ধ থাকায় সেগুলো সরবরাহ করতে পারিনি। ফলে গ্রাহক সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দিতে হয়েছে, বেশ কয়েক মণ আমও নষ্ট হয়ে গেছে। কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার কারণে কোনো অর্ডারও আসেনি। সব মিলিয়ে চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।

নারী উদ্যোক্তা নাদিরা পারভীন রান্নার উপাদান নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেন, আমার ব্যবসা অনলাইনে হওয়ায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আমার ৬০ ভাগ অর্ডার আসে ফেসবুক পেজ থেকে। মেসেঞ্জার, হোয়াটসআ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল থেকে বাকিটা। নেট বন্ধের কারণে কোনো অর্ডার পাইনি। এখন নেট খুললেও ফেসবুক বন্ধ থাকায় কাস্টমাররা আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। নেট বন্ধের আগে যে অর্ডারগুলো পেয়েছিলাম, সেগুলো সরবরাহ করতে পারিনি। যাদের খুবই জরুরি, তারা ফোন দিয়ে অর্ডার করেছেন। ব্যক্তিগত ডেলিভারি ম্যান নিরাপত্তার ভয়ে কাজে না আসায় পাঠাও কুরিয়ারের মাধ্যমে সেগুলো সরবরাহ করেছি। কিন্তু সেটা খুবই কম। আমার বিদেশি অর্ডারগুলো সব ক্যান্সেল হয়ে গেছে।

শাফাত কাদির সম্প্রতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমই) উদ্যোগে বর্ষসেরা পুরুষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের অনলাইনভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। করপোরেট ও ব্যক্তিগত ক্লায়েন্টের কাছে সেল দেওয়ার পাশাপাশি আমরা আমাদের পণ্যগুলোর একটি বড় অংশ অনলাইনে সেল হয়। প্রথমে নেট ছিল না, পরে চালু হলেও এখন পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ আছে। ফলে আমাদের সেল বাজেভাবে কমে গেছে। গত ১০ দিতে আমাদের মোট বিক্রির প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। আরেকটু বিস্তারিত বললে, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি ঘণ্টায় যে পরিমাণ বিক্রি হয়, তা গত ১০ দিনে হয়েছে। এদিকে, মাসের শেষ দিকে হওয়ায় অফিস স্টাফদের বেতন-ভাতা দেওয়া এবং কারাখানা ব্যয় নিয়েও খুব সমস্যায় পড়ে গেছি। তবে সরকার যেহেতু নেট চালু করে দিয়েছে, আস্তে আস্তে সবকিছু দ্রুতই স্বাভাবিক হবে আশা করছি।

আরিফ মো. ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়া সম্প্রতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমই) উদ্যোগে দেশের শিক্ষাখাতে বিশেষ অবদানের জন্য বর্ষসেরা ‘পুরুষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা’ ক্যাটাগরি পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়েছে, ইন্টারনেট না থাকার কারণে কোনো প্রোডাক্ট বা সার্ভিস দিতে না পারা। অনলাইনে আমাদের সব অর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে। অনলাইনে শিশু ও অভিভাবকদের জন্য যেসব কোর্স আমরা করাচ্ছিলাম, সেগুলো আর করাতে পারছি না। আমাদের সেন্টারগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে, যেখানে এসে শিশুরা বিভিন্ন সৃজনশীল কোর্স করে। সব মিলিয়ে আমাদের ৯০ শতাংশের বেশি সেল কমে গেছে।

তিনি বলেন, আর্থিক ক্ষতির চেয়ে আরও বড় যে ক্ষতি, সেটি হচ্ছে ইউজার বা ক্লায়েন্ট হারানো। হারিয়ে যাওয়া ক্লায়েন্টদের আবারও ফিরিয়ে আনতে পারবো কি না, সেটা নিয়েই চিন্তা বেশি। কারণ গত ৭-৮ বছরে এই ইউজার বেজ তৈরি করেছি আমরা। কোটি টাকা খরচ করেও তাদের আবার ফিরিয়ে আনতে পারবো কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *