ইথিওপিয়ার এয়ারলাইনস আফ্রিকায় সেরা, এগোতে পারছে না বিমান
দুই দশকের বেশি সময় ধরে সীমান্ত নিয়ে ইরিত্রিয়ার সঙ্গে বিরোধ চলছে ইথিওপিয়ার। ২০২০ সালের নভেম্বরে নিজ ভূখণ্ডের ভেতর ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী ও তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। বিরোধপূর্ণ সীমান্ত ও গৃহযুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সূচকে ইথিওপিয়ার অবস্থান বেশ ভঙ্গুর। কভিড মহামারী ও যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতির মধ্যেও সফলভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইনস ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস। হয়েছে আফ্রিকার সেরা। অন্যদিকে ইথিওপিয়ার চেয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রায় সব সূচকেই এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ক্ষেত্রে এ চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়া তো দূরের কথা উল্টো বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনে আসছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে এয়ারলাইনস পরিচালনা, একটি কার্যকর ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা, কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান, আফ্রিকা অঞ্চলে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে থাকার মনোভাব, লাভজনক গন্তব্য ও উপযোগী এয়ারক্রাফট বাছাই করতে পারার মতো সক্ষমতার কারণেই আজকের অবস্থানে উঠে আসতে পেরেছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস। যাত্রীসেবার দিক দিয়ে এটি সুনাম অর্জন করেছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রবন্ধেও আফ্রিকার এ বিমান সংস্থাটির শীর্ষে উঠে আসার নানা দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ‘দ্য জার্নি অব ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে এটি আফ্রিকার সেরা বিমান সংস্থার পাশাপাশি বিশ্বের উল্লেখযোগ্য এয়ারলাইনসে পরিণত হয়েছে। এয়ারলাইনসটির বিনিয়োগ রয়েছে শাদ, আইভরি কোস্ট, গিনি, মালায়ি, মোজাম্বিক ও জাম্বিয়ার উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থায়ও।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকেই বৈশ্বিক এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ, নতুন বাজার খুঁজে বের করা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের ধারাবাহিক উন্নতি বজায় রাখে। নতুন পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার উদ্যোগে ২০০৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০১১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১৫ বছর মেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়। এসব লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়নের ফলে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পারফরম্যান্সে উন্নতির পাশাপাশি নতুন বাজার সম্প্রসারণ ঘটে। ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচ বছরে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস আফ্রিকার সবচেয়ে বড় এয়ারলাইনসে পরিণত হয়। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রী পরিবহনের পরিমাণ চার গুণ বেড়ে যায়। এ সময়ে তিন গুণ বাড়ে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য পরিবহন। ২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে ৩৩টি বিমান থেকে বেড়ে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের বিমানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩০-এ। মূলত এ সময়েই প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটে। প্রতিষ্ঠানটির এ অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তেওলদে গেব্রেমারিয়াম। বিমানের বহন আধুনিকায়ন, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি ও যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর মাধ্যমে এয়ারলাইনসটি নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. এমএ মোমেন বলেন, ‘২০০৪-০৫ সাল থেকে ইথিওপিয়ার এভিয়েশন খাত এগিয়ে যেতে থাকে। ওই সময় অনেকটা এগিয়েও যায় তারা। এরপর ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের একটা খারাপ সময় গেছে। যারা দেশটির এভিয়েশনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাদের সরিয়ে দেয়া হয়। যদিও এরপর আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে তারা। দেশটির সফলতার মূল কারণ তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। আসলে পেশাদারত্ব ছাড়া এভিয়েশন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। আবার সঠিক মানুষকে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
১৯৪৬ সালে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস। এরপর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্স কন্টিনেন্টাল অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন এয়ারলাইনসের (টিডব্লিউএ) সঙ্গে অংশীদারির মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সমৃদ্ধ করেছে সংস্থাটি। ১৯৭৫ সালে টিডব্লিউএ চলে যাওয়ার পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস। সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এয়ারলাইনসটির কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে। এর প্রভাবে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পরিস্থিতিতে পড়ে। তবে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। মূলত স্বতন্ত্র করপোরেট কাঠামো, আত্মনির্ভরতা, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মানিয়ে চলার সক্ষমতার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। এ সময়ে অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের উন্নয়ন, টুরিজমের প্রসার ও স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে সুবিধা পায় বিমান সংস্থাটি। অন্যদিকে এ সময়েও সরকারের বেশকিছু ভুল নির্দেশনা ও পরীক্ষামূলক নীতি প্রয়োগের কারণে প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। প্রতিষ্ঠানটি থেকে অনেক দক্ষ ও পুরনো কর্মী পদত্যাগ করতেও বাধ্য হন। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠানটির দুজন পুরনো কর্মী সিইও এবং ডেপুটি সিইও হিসেবে ফিরে আসেন। এর পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি আবারো ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করে।
ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের বহরে বর্তমানে সব মিলিয়ে ১৩৫টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘ দূরত্বে যাত্রী পরিবহনের জন্য ১৮টি এয়ারবাস এ ৩৫০-৯০০ এক্সডব্লিউবি, ১৯টি বোয়িং বি ৭৮৭-৮, আটটি বোয়িং বি৭৮৭-৯, চারটি বোয়িং বি৭৭৭-৩০০ ইআর, ছয়টি বোয়িং বি৭৭৭-২০০ এলআর ও তিনটি বোয়িং বি৭৬৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ রয়েছে। মাঝারি দূরত্বের জন্য রয়েছে ১৯টি বোয়িং বি৭৩৭-৮০০, চারটি বোয়িং বি ৭৩৭ ম্যাক্স, নয়টি বোয়িং বি৭৩৭-৭০০ এনজি উড়োজাহাজ। আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ পথে যাত্রী পরিবহনের জন্য রয়েছে ৩২টি কিউ৪০০ বোম্বার্ডিয়ার উড়োজাহাজ। এছাড়া কার্গো ও অনির্ধারিত ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ১০টি বোয়িং বি৭৭৭-২০০ এলআরএফ ও চারটি বোয়িং বি৭৩৭-৮০০এফ উড়োজাহাজ রয়েছে। অন্যদিকে এয়ারলাইনসটির বহরে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে আরো ৩৪টি এয়ারক্রাফট। এর মধ্যে রয়েছে দুটি এয়ারবাস এ ৩৫০-৯০০ এক্সডব্লিউবি, দুটি বোয়িং বি৭৮৭-৯, পাঁচটি বোয়িং বি৭৭৭-২০০ এলআরএফ ও ২৫টি বোয়িং বি৭৩৭ ম্যাক্স ৮এস এয়ারক্রাফট। ২২টি অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের পাশাপাশি আফ্রিকা, আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ১২৭টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে যাত্রী পরিবহন করছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস।
অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ প্রায় সব সূচকেই ইথিওপিয়ার তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিকের সুবাদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশী যাত্রী রয়েছেন অনেক। উপযুক্ত সেবা পেলে বাংলাদেশের যাত্রীরা বাংলাদেশ বিমানকেই বেছে নেবেন। এছাড়া ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সম্ভাবনা থাকলেও যথাযথ পরিকল্পনা ও পেশাদারির অভাবে দিন দিন বাংলাদেশ বিমানের গন্তব্যের সংখ্যা কমেছে। এতে বছর বছর সংস্থাটির লোকসানের পাল্লা আরো ভারী হয়েছে। সর্বশেষ ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২১ হিসাব বছরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৯৪০ কোটি টাকায়।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘ইথিওপিয়ার সফলতার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। দেশটি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা এয়ারলাইনস নিজেরা চালায় না, বিদেশী ম্যানেজমেন্টের আওতায় চলে। সেই বিদেশী ম্যানেজমেন্ট যেন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার কাজটি করতে পারে তা নিশ্চিত করতে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়। এজন্যই আজ সফলতার একটি কেস স্টাডি হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।’
তিনি বলেন, এভিয়েশন খাত পরিচালনায় উচ্চ মাত্রার পেশাদারত্বের প্রয়োজন হয়, আমাদের এখানে যা কখনই উন্নয়ন হয়নি। আমাদের ৫০ বছরে ৪৩ জন এমডি ও সিইও দায়িত্বে এসেছেন। বিদেশী ম্যানেজমেন্টের আওতায় গেলেই সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাবে, এমনটা নয়। অন্যদিকে ইথিওপিয়া এয়ারলাইনসটিকে বাণিজ্যিকভাবেই চালানোর ব্রত নিয়েছে। তারা সফলতার সঙ্গে এটা বাস্তবায়নও করেছে। শুধু বিমান নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া রাষ্ট্রীয় যত পরিবহন ব্যবস্থা আছে কোনোটিই লাভজনক হতে পারে না।
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা হিসেবে যাত্রা করা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে বর্তমানে ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮, দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯, ছয়টি বোয়িং ৭৩৭ এবং পাঁচটি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান সাতটি অভ্যন্তরীণ ও ১৬টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। একসময় বিমানের আন্তর্জাতিক রুটের সংখ্যা ২৯টি হলেও বর্তমানে তা কমে ১৬টিতে দাঁড়িয়েছে।
যাত্রীসেবা নিয়েও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থার বিরুদ্ধে। এ বছরের এপ্রিলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আয়োজিত গণশুনানিতে যাত্রীরা রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থাটির বিরুদ্ধে ফ্লাইট শিডিউল ঠিক না থাকা, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ফ্লাইট পরিবর্তনের তথ্য যাত্রীদের না জানানোর অভিযোগ করেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও (অতিরিক্ত সচিব) ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল বলেন, বিমানের উন্নতি বা সফলতার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি আমরা। চেষ্টা অব্যাহত আছে। বিমান শুধু ব্যবসা করে না। বিমানের অনেক ইতিবাচক বিষয় রয়েছে। যেগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপন হচ্ছে না। আমরা পিছিয়ে নেই। ইথিওপিয়ার সফলতা বা দ্রুত উন্নতির বিষয় বলতে গেলে অনেকগুলো মাপকাঠির বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। যেমন দেশটির ফ্লিট কোনগুলো, সিট ক্যাপাসিটি কত, কোনটা কত দামে কেনা হয়েছে, তাদের ফুয়েল নেয়ার সস্তা উৎস আছে কি না—এমন আরো বেশকিছু বিষয় আছে। ন্যূনতম ১৮টি বিষয় রয়েছে। সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করা সমীচীন হবে।