আস্থার প্রতীক হয়ে উঠছেন জাকের আলী
২০২৪ সালের মার্চে সিলেটে শ্রীলংকার সঙ্গে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ডাক পড়ে তার। প্রথম ম্যাচেই দেখিয়ে দিলেন সাহস আর পেশিশক্তি। ২০৭ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ২০৩ রান তুলে ফেলেছিল এই জাকেরের বীরত্বেই। ৩৪ বলে ৪ বাউন্ডারি ও ৬ ছক্কায় ৬৮ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলে সেদিন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম জয় করেন জাকের। যদিও বাংলাদেশ মাত্র ৩ রানে হেরে যায়। তাতে বিফলেই যায় জাকেরের দৃষ্টিনন্দন ইনিংসটি।
ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক মঞ্চে সেই জাকেরের আলোতে আসা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিয়মিতই টি-টোয়েন্টি খেলে যাচ্ছেন বাংলাদেশের হয়ে। চলতি বছর পরপর দুই মাসে ওয়ানডে ও টেস্ট অভিষেকও হয়ে যায় তার। অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে অভিষেক ঘটে জাকের আলীর। পরের মাসে আরব আমিরাতে ওয়ানডে অভিষেক হয় তার। অভিষেক টেস্টে ফিফটি করে আস্থার প্রতিদান দেন জাকের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও হেসেছে তার ব্যাট। অ্যান্টিগায় ৫৩ ও ৩১ রানের দুটি ইনিংস খেলার পর জ্যামাইকা টেস্টে বাংলাদেশকে জেতাতে মূল্যবান অবদান রাখেন তিনি। ওই টেস্টে ৯১ রানের লড়াকু ইনিংস খেলেন জাকের।
টেস্টের পাশাপাশি চলছিল তার ওয়ানডের পথচলাও। শারজায় দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়ে ৩৭ ও ১ রানের দুটি ইনিংস খেলেন। এরপর সেন্ট কিটসে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে তার ব্যাট থেকে এসেছে যথাক্রমে ৪৮, ৩ ও ৬২ রানের তিনটি ইনিংস। বাংলাদেশ হারলেও জাকের আলী বুঝিয়ে দেন, তিনি ভবিষ্যতে মিডল অর্ডারের কাণ্ডারি হয়ে ওঠার মতো যোগ্যতা রাখেন।
এরপর টি-টোয়েন্টি সিরিজে তো সত্যিই দলের কাণ্ডারি হয়ে উঠলেন। ২৭ বলে ২৭, ২০ বলে ২১ রান করে হয়তো আক্ষেপে পুড়ছিলেন তিনি। তৃতীয় ম্যাচে তাই হৃদয় নিংড়ে খেলেছেন। তার ব্যাটে কচুকাটা হয়েছেন আলজারি জোসেফ, ওবেড ম্যাকয়রা। একে একে বল আছড়ে মারছিলেন আর্নস ভেল স্টেডিয়ামের বাইরে। ৪১ বলে ৭২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে যখন ড্রেসিংরুমের দিকে ফিরছিলেন জাকের আলী তখন তরুণ ধারাভাষ্যকার নিখিল উত্তামচান্দানি বলছিলেন, ‘ইটস জাকের-শো, সুপারস্টার ইন দা মেকিং।’
মিডল অর্ডারে আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠা জাকের আলী এরই মধ্যে তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের তারকা। এখন তার মহাতারকা হয়ে ওঠার অপেক্ষা।
নিজের সঙ্গেই যেন বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন জাকের আলী। গত জুনে ওয়েস্ট ইন্ডিজে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চারটি ম্যাচ খেলেন তিনি। একটিতে ১৪ রানে অপরাজিত ছিলেন, বাকি তিন ম্যাচ মিলিয়ে রান ছিল মোট ২১। এরপর দেশে ফিরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলেন নীরবে। পুরস্কারও পেলেন দ্রুতই। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে তিন সংস্করণেই তিনি উজ্জ্বল। গতকাল ম্যাচসেরার পুরস্কার নিয়ে তিনি বললেন, ‘সবকিছুই মানসিকতার ব্যাপার।’
সফল এ সফর নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার জন্য দারুণ এক সিরিজ—টেস্ট সিরিজ, ওয়ানডে সিরিজ ও এখন টি-টোয়েন্টি সিরিজ। গত দুই ম্যাচের তুলনায় আজকে উইকেট খুব ভালো ছিল। আমি চেষ্টা করছিলাম সময় নিতে, নিজেকে সময় দিতে। জানতাম, যদি খেলাটাকে গভীরে নিতে পারি, তাহলে রান করতে পারব।’
অথচ গল্পটা হতাশারও হতে পারত। জাকেরের রান এক পর্যায়ে ছিল ১৭ বলে ১৬। রোস্টন চেজের করা ১৫তম ওভারের তৃতীয় বলে ২ রান নিতে চেয়েছিলেন জাকের। ১ রান নেয়ার পর জাকের দৌড় শুরু করলেও শামীম হোসেন সাড়া দেননি। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, জাকের রানআউট। কারণ দুজনেই এক প্রান্তে। ক্ষুব্ধ জাকের ফিরে যান ড্রেসিংরুমে। যদিও তৃতীয় আম্পায়ার ভিডিও রিপ্লেতে দেখেছেন, জাকের নয়, শামীম রানআউট! তখন আম্পায়ারের ডাকে ফিরতে হলো তাকে।
ফেরার পরই একই ওভারে রানআউট শেখ মেহেদী হাসান। তাতে চরম হতাশ হন জাকের আলী। যদিও হাল ছাড়েননি। নতুন জীবন পেয়ে তিনি বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন। শেষ পাঁচ ওভারে তার ব্যাট থেকে আসে তিনটি চার ও পাঁচটি ছক্কা।
রানআউট হয়ে ড্রেসিংরুমে যাওয়া ও ফিরে আসা নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভয়ংকর এক ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ড্রেসিং রুমে ফিরে নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল আমার, ব্যাট-প্যাড একেক দিকে ছড়িয়ে ছিল। হঠাৎ তৃতীয় আম্পায়ার (চতুর্থ আম্পায়ার) ডাকলেন আমাকে। এরপর আরেকটি রান আউট হলো, ওই সময় ভেঙে পড়েছিলাম আমি। তবে সৌভাগ্যবশত দলের জন্য খেলতে পেরেছি, রান করতে পেরেছি।’
এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপে দ্বীপে খেলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি বলেন, ‘সবকিছু হলো মানসিকতার ব্যাপার। আমি জানতাম, ক্যারিবিয়ানরা যেকোনো সংস্করণেই কঠিন পরীক্ষা নেবেন। বিশেষ করে, এ কন্ডিশনে। এখানে বিশ্বকাপ খেলেছি আমি, কিন্তু ভালো করতে পারিনি। দেশে ফেরার পর এই সফরের জন্য সুনির্দিষ্ট করে প্রস্তুতি নিয়েছি। সবকিছু আমার জন্য ভালো যাচ্ছে এখন।’
সিরিজটা স্পিনার শেখ মেহেদী হাসানেরও। শেষ ম্যাচে ৩ ওভার বোলিং করে ১৩ রান দিয়ে নেন ২টি উইকেট। জাস্টিন গ্রিভস ও নিকোলাস পুরান তার শিকার হয়েছেন। গোটা সিরিজেই তিনি উজ্জ্বল। প্রথম ম্যাচটা ছিল কেবলই ‘মেহেদী-শো’। ব্যাট হাতে ২৪ বলে ২৬ রান করার পর ঘূর্ণি বলে ৪ ওভারে ১৩ রানে নিলেন ৪ উইকেট। ওই ম্যাচে ৭ রানের নাটকীয় জয়ে সিরিজে লিড নেয় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ম্যাচে ১৭ বলে ৩৫ রান করে শামীম হোসেন ম্যাচসেরা হলেও মেহেদীর অবদানও কম নয়। তিনি ২০ রানের খরচায় নেন জনসন চার্লস আর নিকোলাস পুরানের উইকেট। সব মিলিয়ে ৩৫ রান করেছেন, উইকেট নিয়েছেন ৮টি। সিরিজের সেরা নির্বাচনে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
পুরস্কার নেয়ার পর জানিয়েছেন, কীভাবে তিনি ক্যারিবীয় টি-টোয়েন্টির হার্ডহিটারদের থামিয়েছেন। পুরান এ বছর সর্বোচ্চ ১৭০টি ছক্কা মেরেছেন। সেই ব্যাটারকে সিরিজে তিনবারই স্পিনের মায়াজালে বন্দি করলেন মেহেদী। কীভাবে সম্ভব হলো?
এ নিয়ে মেহেদী বলেন, ‘বিপিএলে ও অন্যান্য দলে একসঙ্গে খেলায় পুরানকে খুব ভালো করেই জানি আমি। অফ স্পিনারদের বিপক্ষে পুরানের কাজ কঠিন হয়ে ওঠে, এটা জানি আমি। এটাই ছিল পরিকল্পনা এবং ভালোভাবে প্রয়োগ করে আমরা সফল হতে পেরেছি।’
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথমবার সিরিজসেরা হওয়া মেহেদী বলেন, ‘এই ধরনের উইকেটে বোলিং উপভোগ করি আমি। বিশ্বকাপেও দেখেছিলাম এখানে চটচটে ও নিচু বাউন্সের উইকেট। সিরিজের আগেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল উইকেট সোজা বল করা। এ ধরনের উইকেটে সঠিক নিশানায় বল করাই গুরুত্বপূর্ণ।’