আলুর দাম তলানিতে, দিশেহারা কৃষক

স্টাফ রিপোর্টার

বগুড়ায় আলুর দাম ঠেকেছে তলানিতে । দাম না থাকায় অনেক কৃষক খেত থেকে আলু তুলছে না। খোলাবাজারে সাদা আলু কেজিপ্রতি ১০-১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।আর পাইকারি বাজারে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে সাত থেকে আট টাকায়।তবে কৃষক পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ছয় টাকা।

কৃষকরা জানান, এই সময়ে মূলত পাকড়ি জাতের আলুর ফলন হয়। গত বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) পাইকারি বাজারে সর্বোচ্চ ১০ টাকা ২০ পয়সা কেজি দরে এ আলু বিক্রি হয়েছে। যদিও এক কেজি পাকড়ি জাতের আলুর উৎপাদন খরচ এই মৌসুমে হয়েছে প্রায় আট টাকা।

গত কয়েকদিন বগুড়ার মহাস্থান পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলুর কেজি সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিমণ আলু বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৬০ টাকায়।গত দুই সপ্তাহ আগেও যে আলু বিক্রি হয়েছে ২০-২৫ টাকা কেজি সেই আলু এখন পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ছয় টাকা কেজিতে। আলুর মোকাম হিসেবে পরিচিত বগুড়াতেই আলুর দাম এখন নিম্নমুখি। এতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

হাটে সাদা গ্র্যানুলা প্রতিমণ আলুর দর ছিলো ২২০ থেকে ২৬০ টাকা, অ্যাস্ট্রারিক বা স্টিক, কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, ও ক্যারেট জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০০ সাড়ে ৩৫০ এবং লাল পাকড়ি জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা মণ দরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ার উৎপাদিত উন্নতমানের আলু জেলা ও দেশের চাহিদা পূরণ করে রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। প্রায় এক যুগ ধরে এ জেলার আলু রফতানি হচ্ছে এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, নেপাল, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের সৌদিআরব, বাহরাইন, সংযুক্তআরব আমিরাতে।

জেলার মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয়। এ উপজেলায় বিভিন্ন জাতের আলুর চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে যেসব আলু বেশি হয়ে থাকে সেগুলো হলো স্থানীয় জাতের পাকড়ি ও হাগড়াই। এ ছাড়াও উচ্চ ফলনশীল আলু অ্যালভেরা, গ্র্যানোলা, অ্যাস্ট্রারিক বা স্টিক, কার্ডিনাল, ডায়মন্ড রয়েছে।

কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ডায়মন্ড, অ্যাস্ট্রারিক ও ক্যারেট জাতের আলুর চাহিদা বিদেশে বেশি।

বগুড়া সদর, শিবগঞ্জ উপজেলা, ঘোড়াধাপ, নামুজা, চাঁদমুহা এলাকার কয়েকজন আলু চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে আলুর প্রচুর আমদানি হলেও শীত বেশির কারণে বাইরের পাইকাররা হাটে আসছেন না। আর এতেই আলুর দরপতন ঘটেছে।

শিবগঞ্জ উপজেলা তেঘরি এলাকার আলু চাষি ছামসুল ইসলাম জানান, আলুর দাম কম। আলু বিক্রি করে খরচ উঠেছে না। ১২ মণ গ্র্যানুলা আলু বিক্রি করেছি ২৪০ টাকা মণ দরে।

শিবগঞ্জ উপজেলার মিরেরচক গ্রামের বাসিন্দা মহাস্থান হাটের ব্যাপারী মজনু মিয়া জানান, প্রতিদিন মহাস্থান হাটে প্রচুর আলু আমদানি হচ্ছে। সেই হিসেবে পাইকার বা ব্যাপারিরা আসছেন না। এখানকার বেশিরভাগ আলু শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুরে যায়। কিন্তু বেশি শীতের কারণে ওইসব জেলার পাইকাররা আসছেন না। ফলে দাম পড়ে গেছে। শীত কমলেই আলুর দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

মহাস্থার হাটের শাহ সুলতাল সবজি আড়তের স্বত্বাধিকারী বাবু মিয়া বলেন, এখনো বেশ কিছু হিমাগারে পুরোনো আলু মজুত রয়েছে। সেই আলুগুলো ২০০ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। কিছু ব্যাপারি লাভের আশায় সেসব আলু ধুয়ে বাইরে জেলায় নিচ্ছেন। এজন্য নতুন আলু বিক্রিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে।

বগুড়ার মোকামতলা এলাকায় কৃষক আব্দুর রহমান প্রতিবছর জমিতে আলু চাষ করেন। তার মতে, এবার শুরু থেকেই আলুর বাজার পড়ে গেছে। গত বছর আলুর দাম ভালো ছিল। তাই এবার আলুচাষির সংখ্যা ও জমির পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু দাম কমে যাওয়ায় তাদের এখন মাথায় হাত।

শিবগঞ্জের আমতলী এলাকার কৃষক আলী আকবর জানান, সাদা হলান্ড আলু এখনকার বাজারে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ টাকা কেজি। অথচ এই আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে এখন ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা করে লোকসান দিতে হচ্ছে। লাল পাকড়ি আলুর কেজি ১০ টাকা হিসাবে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায়। এ আলুতেও কৃষকের প্রতি কেজিতে লোকসান না হলেও লাভ হচ্ছে না। এরপরও হাটে ক্রেতা নেই।

বগুড়ার মহাস্থান হাট ঘুরে দেখা গেল সেখানে আলু কিনতে ব্যাপারীদের টানা-হেঁচড়া নেই। হাটে আসা আব্দুল গফুর নামের একজন বলেন, আলু নিয়ে সারা দিন বসে থেকেও ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছি না। এখন হাটেও দাম নেই, মাঠেও দাম নেই।

বগুড়ার কৃষি অধিদপ্তর বলছে, জেলায় মোট ৩৬ আলু সংরক্ষণের হিমাগার সচল রয়েছে।হিমাগারগুলোতে প্রতি বছর দুই লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা হয়। হিমাগারগুলো আলু কেনা শুরু করলে আলুর দাম বাড়বে।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ দুলাল হোসেন জানান, সবজি হিসেবে আলুর উৎপাদন বরাবরই ভালো। গত বছর আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ফলন ভালো পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দাম সামান্য কমেছে। এছাড়া শীতের কারণে বাইরের জেলায় পাইকাররা না আসায় দাম কিছুটা কমেছে। তবে শীতের প্রকোপ কমলে পাইকার আসতে শুরু করবে। সেই সঙ্গে সংরক্ষণের জন্য হিমাগারগুলো আলু কেনা শুরু করলে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *