আর্থিক অপরাধের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠছে হংকং

স্টাফ রিপোর্টার

এশিয়ার অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র হংকংয়ের দিকে অভিযোগের তীর ছুড়েছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা। চীনের সঙ্গে দেশটির বিদ্যমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উত্তেজনার চাপ স্পষ্ট এ অভিযোগে। আইনপ্রণেতাদের মতে, চীনের অধীনে থাকা অঞ্চলটি আর্থিক অপরাধের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠছে। শহরটি এখন অর্থ পাচার ও নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য অন্যতম শীর্ষস্থান। বিশেষ করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বাণিজ্যের জন্য হংকং ব্যবহার হচ্ছে। প্রতিনিধি পরিষদে আইনপ্রণেতাদের পরামর্শ হলো মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন যেন হংকংয়ের ব্যাংক খাতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করেন। খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।

হংকং বিষয়ে সাম্প্রতিক মূল্যায়নটি করেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টিবিষয়ক মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচিত কমিটির দ্বিদলীয় নেতারা। তারা ইয়েলেনকে পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছেন, হংকং এখন অনেক ধরনের মার্কিন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ লঙ্ঘনের কেন্দ্রে রয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ায় পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি রফতানি এবং ইরান থেকে জ্বালানি তেল ক্রয়ের জন্য ছদ্মবেশী প্রতিষ্ঠান তৈরির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

সোমবার প্রকাশিত চিঠিতে স্বাক্ষর করেন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জন মুলেনার ও ডেমোক্র্যাট রাজা কৃষ্ণমূর্তি। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার সম্ভাব্য অপব্যবহার” করছে হংকং। হংকংয়ের আর্থিক খাত ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আরো কঠোর নজরদারি এবং ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন বলে তারা উল্লেখ করেছেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্বস্ত বৈশ্বিক আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে হংকংয়ের পরিচিতি রয়েছে। সে পরিচিতি থেকে এখন অঞ্চলটি চীন, ইরান, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে বৃহত্তম কর্তৃত্ববাদী অক্ষের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। এখন প্রশ্ন করা উচিত, হংকংয়ের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত মার্কিন নীতি, বিশেষ করে এর আর্থিক ও ব্যাংক খাতের ক্ষেত্রে এখনো যথাযথ কিনা।

জন মুলেনার ও রাজা কৃষ্ণমূর্তি এ মূল্যায়নে কিছু পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে হংকং থেকে রাশিয়ায় রফতানীকৃত প্রায় ৪০ শতাংশ পণ্য ছিল”অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত, যার ওপর মার্কিন বিধিনিষেধ রয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর, যা ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাশিয়া ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

তারা বলেন, ‘‌হংকং এখন নিষিদ্ধ পশ্চিমা প্রযুক্তি আমদানি ও রাশিয়ায় পুনঃরফতানি, নিষিদ্ধ ইরানি জ্বালানি তেল ক্রয়ের জন্য ছদ্ম প্রতিষ্ঠান গঠন, রাশিয়ার স্বর্ণ বাণিজ্য সহজতর করা এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে অবৈধ বাণিজ্যে জড়িত “‍ঘোস্ট শিপ’’ পরিচালনার মতো কর্মকাণ্ডে বৈশ্বিক নেতৃস্থানীয় স্থানে রয়েছে।’

অবশ্য বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিক মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় ও নিউইয়র্কে হংকংয়ের বাণিজ্য অফিসের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

মার্কিন দুই আইনপ্রণেতা অভিযোগে জানান, কয়েক বছর ধরে এ অপরাধের প্রবণতা দেখা যাবে। বিশেষ করে ২০২০ সালে বেইজিংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর হংকং কর্তৃত্ববাদী অক্ষের অংশে পরিণত হয়েছে।

চিঠিতে তারা উল্লেখ করেছেন, এ ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা অনুরোধ জানাই হংকং ব্যাংকগুলোর সঙ্গে মার্কিন ব্যাংকিং সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা, হংকংয়ের অবস্থান ও মনোভাবের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের নীতিতে কী পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং এ ঝুঁকি মোকাবেলায় অর্থ মন্ত্রণালয় কী পদক্ষেপ নিতে চায় সে বিষয়ে যেন মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় বিস্তারিত জানায়।

গত মে মাসে মার্কিন প্রশাসন হংকং ও চীনের ২০টি কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হলো রাশিয়াকে সামরিক ও উন্নত শিল্পসামগ্রী সরবরাহে ভূমিকা রয়েছে হংকং ও মূল ভূখণ্ডের এসব চীনা কোম্পানির। এছাড়া গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন কংগ্রেস হংকংয়ের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য অফিসগুলো বন্ধ করার জন্য একটি বিল পাস করেছে। এতে হংকংকে রাশিয়ার জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পরিবহন কেন্দ্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে সামরিক ও বেসামরিক উভয় কাজে ব্যবহৃত পণ্য রফতানি করা হয়।

চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, হংকংয়ের শাসক জন লি কা-চিউ মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার ‘কোনো আইনগত ভিত্তি নেই’ বলে উল্লেখ করেছেন। ২০২০ সালে তিনি নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসেন এবং মার্কিন এ ব্যবস্থাকে ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেছেন।

২০২২ সালে জন লি কা-চিউ জানিয়েছিলেন, তার প্রশাসন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করবে না। ওই সময় নিষিদ্ধ রুশ ধনকুবের অ্যালেক্সেই মরদাশভের ইয়ট ‘নর্ড’ হংকংয়ের জলসীমায় ছিল, যা মার্কিন ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন করে যে হংকং নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য একটি আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে।

তখন লি জানান, জাতিসংঘ আরোপিত না হলে তাদের পক্ষে এমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগের ‘কোনো আইনগত ভিত্তি’ নেই।

মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের মতে, লি কা-চিউ ও হংকং প্রশাসনের এমন অবস্থান অঞ্চলটির ব্যাংক খাতে আস্থা কমাতে পারে। এখানে আরো কঠোর নজরদারির দরকার হতে পারে।

চীনের মতো হংকংয়েও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপড়েন রয়েছে। ভিন্নমতের বিরুদ্ধে অঞ্চলটির অবস্থানকে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইন’ এখানে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার নষ্ট হয়েছে।

মার্কিন আইন প্রণেতাদের সর্বশেষ এ মূল্যায়ন এসেছে এমন সময়, যার এক সপ্তাহ আগে হংকংয়ের একটি আদালত ৪৫ বিরোধী ব্যক্তিত্বকে ৪-১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে চার বছরেরও বেশি আগের নির্বাচনে বিদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *