আটকে আছে সিটি ও মেঘনা গ্রুপের প্রায় ৫০ কোটি ডলারের এলসি
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ডলার সংকট। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে ঘাটতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রভাব মোকাবেলা করতে হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। প্রায় ৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে আছে দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দুই কনগ্লোমারেট সিটি ও মেঘনা গ্রুপ। কিন্তু ডলার সংকটে ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট—এলসি) খুলছে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো।
প্রতি বছর রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে সংকটের পাশাপাশি দেখা যায় অন্যায্য মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা। আসন্ন রমজানেও একই পরিস্থিতি এড়াতে রয়েছে তত্পরতা। তবে অন্যবারের তুলনায় এবারের সংকট ভিন্ন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা, যা গতকাল আমদানি-রফতানিসহ সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের ‘বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটি’র সভায় আলোচনা হয়েছে। সেখানে রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকারকরা আমদানির ঋণপত্র খুলতে না পারার সমস্যার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সভায় উপস্থিত বেসরকারি খাতের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘সভায় একটি উপস্থাপনা পেশ করা হয়। সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সমস্যার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। সে সময় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় সিটি গ্রুপের ২৯ কোটি এবং মেঘনা গ্রুপের ২০ কোটি ডলারের ঋণপত্র পেন্ডিং আছে। এখনো খোলা সম্ভব হয়নি। পণ্য আমদানির চুক্তি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। ডলার সংকটসহ নানা সমস্যার কথা জানিয়ে ঋণপত্র খুলছে না ব্যাংকগুলো। অন্য আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, ঋণপত্র খোলার বিষয়ে প্রায় সবারই একই অবস্থা। তবে সিটি ও মেঘনা গ্রুপের পেন্ডিং ঋণপত্রের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। দুই কোম্পানি মিলিয়ে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের ঋণপত্র খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো।’
গতকাল ‘বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটি’র অষ্টম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি। সভা শেষে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী নিজেও ঋণপত্র খুলতে সমস্যার বিষয়টি অবহিত করেন গণমাধ্যমকর্মীদের। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন এলসি খোলার সমস্যা আছে। মূলত এলসি সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়েছে। আলোচনায় উঠে আসা সমস্যাগুলো যে যে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেখানে প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র দেব। কী পদক্ষেপ নিলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যাবে সে ব্যবস্থা আমরা নেব। আমাদের আলোচনায় আরো যে বিষয়টি উঠে এসেছে, রমজান মাস আসছে, সেটা আমাদের মাথায় আছে। বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে সিটি গ্রুপ থেকে বলছে যে তাদের এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকের যিনি আসছেন তিনি বলেছেন ব্যাপারটা দেখবেন। আমরা সবাই এ ব্যাপারে সতর্ক আছি। শিগগিরই আমরা বড় ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে পারি কিনা, সেটা এক সপ্তাহের মধ্যে আবার বসে দেখব। কোনো অবস্থাতেই রমজান মাসকে সামনে রেখে সাধারণ ভোক্তাদের যেন বিপদ-আপদ না হয়।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাজারে আমরা পণ্যের মূল্যসীমা নির্ধারণ করে দিই। তার পরও এটা ঠিক, কোথাও কোথাও চিনি নিয়ে সমস্যা হয়েছে। কাগজপত্র বলে প্রচুর পরিমাণ চিনি দেশে বা পাইপলাইনে আছে। আমরা চেষ্টা করছি—ভোক্তা অধিকার বিভিন্ন জায়গায় হানা দিচ্ছে, জরিমানা করছে। চিন্তা করছি যদি জেলেরও ব্যবস্থা করা যায়, কারাগারে পাঠানোর সুযোগ থাকলে আমরা করব।’ চিনির শুল্ক কমানোর বিষয়ও ভাবা হচ্ছে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।
সিটি গ্রুপের এলসি খোলার সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের প্ল্যান আছে, তারা সবকিছু ঠিক করেছে, যেটুকু সমস্যা সেটাও তারা কথা বলে নেবে দু-একদিনের মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যারা প্রতিনিধি এসেছেন, তারা কাল-পরশুর মধ্যে রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি পরিষ্কার ইনস্ট্রাকশন তারা দেবেন। রমজান মাসে দাম কমে যাবে তা বলছি না, কিন্তু অন্তত রিজনেবল প্রাইস যেটা হওয়া উচিত সেই হিসাবটা মাথায় রেখে যেন প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হয়।’
গতকাল সভা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ প্রয়োজনীয় সব পণ্যের সরবরাহ ও মজুদ নিশ্চিত করা হবে। সরকার এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। রমজান মাসসহ সারা বছর দেশের মানুষ যাতে প্রয়োজনীয় পণ্য ন্যায়সংগত মূল্যে পেতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হবে। প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। সয়াবিনের পাশাপাশি ভোজ্যতেল সানফ্লাওয়ার ও ক্যানোলা আমদানি শুল্ক কমিয়ে আমদানি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি, সরবরাহ, মজুদ ও মূল্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকার একটি কো-অর্ডিনেশন সেল গঠন করে সার্বিক সহায়তা করবে। চলমান বিশ্বপরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশের মানুষ যেন কষ্ট না পায়, সেজন্য যা কিছু করা প্রয়োজন সরকার সবকিছুই করবে। পণ্যের মূল্য যুক্তিসংগত পর্যায়ে রাখার জন্য সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে।’
সভা পরিচালনা করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ হাসান ইমাম খান এমপি, ওনাস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এমপি, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সভাপতি মাহবুবুর রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান, বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকনসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বক্তব্য রাখেন। এ সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে প্রয়োজনীয় মতামত প্রদান করেন।