অপরিবর্তিত সুদহার : ব্যবসায়ী-অর্থনীতিবিদদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন,২০২৫) মুদ্রানীতি (‘মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট’-এমপিএস) ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারের মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যবসায়ীক বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশা নেই গভর্নরের। তার মতে, গত ২০২৪ ও চলতি ২০২৫ সাল বিনিয়োগ বৃদ্ধির বছর নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসলে চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক ঋণের নীতি সুদহার কমানো শুরু হবে।
তবে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ বহাল রাখা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মাঝে। সুদহার বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে সংকোচনমূলক অবস্থান এবং উচ্চ নীতি সুদহার বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করবে। তবে দ্বিমত পোষণ করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই মূল চ্যালেঞ্চ। এ অবস্থায় সুদহার কমানো হলে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার উপক্রম হবে।
সোমবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ভবনে জানুয়ারি-জুন ২০২৫-এর জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এসময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার, ড. হাবিবুর রহমান, জাকির হোসেন চৌধুরি, কবির হোসেন, বিএফআইইউয়ের প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও সহকারী মুখপাত্রসহ অন্যান্য কর্মকর্তা।
এসময় গভর্নর ড. আহসান এউচ মনসুর বলেন, ২০২৪ ও ২০২৫ সাল বিনিয়োগ বৃদ্ধির বছর নয়। এ দুই বছরে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশা তো দূরের কাথা স্বপ্নও দেখি না। এখন আমাদের প্রধান টার্গেট মূল্যস্ফীতি কমানো। আগামী জুন মাসের মধ্যে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। তখন ধীরে ধীরে নীতি সুদহার কমানো হবে বলে আশা করছি।
অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি নিয়ে উদ্যোক্তা-অর্থনীতিবিদদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শিল্প উদ্যোক্তা, ফকুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিকেএমইএ এর নির্বাহী সভাপতি শামীম এহসান বলেন, ‘সুদহার না বাড়ানোয় সাধুবাদ জানাই, তবে এটা কমানো উচিত ব্যবসার স্বার্থে-অর্থনীতির স্বার্থে। সুদহার বাড়লে পণ্যের দাম বাড়ে, যার প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপরে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ নিম্নআয়ের এ কারণে সুদহার কমানো না হলে, উৎপাদনমুখী শিল্পে কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হোক। এতেও পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। আমরা চাই শিল্প কারখনায় বিনিয়োগে ভালো গ্রাহকের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হোক। যেমন তেল কারখানা মালিক স্বল্প সুদে ঋণ পেলে সে অবশ্যই কম দামে তা সরবরাহ করতে পারবে। যার উপকারভোগী ভোক্তা ভালো থাকবে, কম দামে সেসব পণ্য পাবেন।’
অর্থনীতিবিদ পিআরআই গবেষণা পরিচালক এবং র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির যে প্রবণতা সেখানে নীতি সুদহার না বাড়ালেও চলবে সেটা ঠিক আছে। তবে কারো দাবির পরিপেক্ষিতে কমানো হলে এটা কঠিন হবে। মূল্যস্ফীতির গতি আরও কিছুটা সময় দেখতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো হলে বা কমানো হলে কী ঘটতে পারে সে বিষয়ে বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ ও সীমিত কর্মসংস্থানের চাপ আছে। এখানে সুদ বাড়ানো হলে ব্যবসায় ইফেক্ট আছে, আবার মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কারণ মূল্যস্ফীতি সেহারে এখনও কমেনি, কিছুটা কমেছে মাত্র। সব দিক বিবেচনায় নিতে হবে। সামনে রমজান মাস আছে এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স করছে কি না এটাও একটা বিষয়। তাছাড়া সুদহার কমানো হলে বা কমলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। এটা আরও কিছুটা সময় দেখতে হবে।’
ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের মতো রাখা হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৮ শতাংশ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
এদিকে, গেলো ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। যদিও গত ছয় মাসে লক্ষ্য ছিল ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে (রিজার্ভ মানি) মুদ্রার সরবরাহ বাড়াবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। গত জুনে রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে এ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ২ শতাংশ নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। আগামী নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।
তবে উচ্চ নীতি সুদহার বেসরকারিখাতে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করবে বলে মনে করছেন ঢাকা চেম্বার সভাপতি এবং শিল্প-প্রতিষ্ঠান ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তাসকীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ রাখার পাশাপাশি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় রাখায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা কিছুটা উদ্বেগের কারণ বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে, এই কঠোর অবস্থানের উদ্যোগ বেসরকারিখাতের ঋণ প্রবাহের পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আবার বিনিয়োগের জন্য দেশের বেসরকারিখাত ব্যাংকগুলোর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে থাকে, তবে উচ্চ সুদের হার পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১০.৮৯ শতাংশ হতে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতি ৯.৯৪ শতাংশে নেমে আসা সত্ত্বেও, এটি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নামেনি। বেসরকারিখাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৯.৮ শতাংশে অপরিবর্তীত রাখার সিদ্ধান্ত বেসরকারিখাতকে কিছুটা আশাহত করেছে। যদিও ২০২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৩ শতাংশ, যা বিগত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।’
এ বিষয়ে কথা হয় বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মুদ্রানীতিতে সুদহার না বাড়ানো সঠিক সিদ্ধান্ত। এই সময়ে মূল্যস্ফীতি কোন দিকে যাচ্ছে সেটা অনিশ্চিত। তবে শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে সেটা ধরে নেওয়া বাস্তব সম্মত না। এখন যেহেতু তিন ধাপে সাড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশে উঠানো হয়েছে সেটার প্রভাবতো এখনও বাজারে পুরোপুরি ঢুকেনি। এই অবস্থায় আরেকটু দেখা দরকার যে বৃদ্ধি করা লাগবে কি লাগবে না সেটা আরও দু-তিন মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য দেখে যদি বাড়াতে হয় পরে বাড়ানোটা বেটার। এখনও মূল্যস্ফীতির অন্যান্য কারণ যদি এড্রেস করতে পারে তাহলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। খালি সুদের হার বাড়াতে থাকলাম এতে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে সেটা না। এজন্য আগেও বলেছিলাম এবারে দশে থাকায় কাম্য।’
ব্যবসায়ীরা সুদহার কমানোর কথা বলছেন, এ বিষয়ে ড. জাহিদ বলেন, ‘এই মুহূর্তে সুদহার কমানোটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতো। এখন বিনিয়োগের কথা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এটা বলবেন কারল সুদহার কমলে তাদের আর্থিক খরচ কমবে। বিনিয়োগের অজুহাত দিয়ে সেটা বলা হয়, তবে সুদের হার কম থাকা সময়ে এটা শোনা যায়নি। তবে এ সময়ে যেহেতু মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনাটাই বড় প্রায়োরিটি সেক্ষেত্রে কমালে আগুনে ঘি ঢালার মতো হয়ে যেতো। এখানে বিষয় হলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুদহার বাড়ানো-কমানোর চেয়ে অপেক্ষা করাটাই বাঞ্ছনীয়।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং রিজার্ভ বাড়ানোকে প্রধান চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় গত বছরের ১৮ জুলাই চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মুদ্রানীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেওয়াজ অনুযায়ী সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। কিন্তু রেওয়াজ ভেঙে নজিরবিহীনভাবে কোনো সংবাদ সম্মেলন না করে শুধু ওয়েবসাইটে মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়। ব্যাংক খাতের বিভিন্ন অনিয়ম জালিয়াতির তথ্য আড়াল করতে তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ধারাবাহিকতায় এমন পদক্ষেপ নেন।